সিদ্ধার্থও দাঁড়িয়েছিলেন বহরমপুর থেকেই। ২৪’এর ভোটে ৯৬’এর স্মৃতি

১৯৯৬ থেকে ২০২৪। বদলেছে দিন। কিন্তু বদলেছে ভোট ? এই বহরমপুরেই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী  সিদ্ধার্থ শংকর রায়। বহরমপুর দেখেছে অধীর চৌধুরীর উত্থান। সেবার নাম আর কাগজের নাম  বলতেই রেগেমেগে আগুন হয়ে বললেন, “ মানু, দ্যাখো  দ্যাখো এই ছেলেটাই  তোমাকে  গব্বর সিং ভিলেন বানিয়েছে, ওর এডিটর এমএজ আকবরকে  কে কমপ্লেন করে ওর চাকরি খেয়ে নিয়ে ওকে পুলিশে দাও”। হাই ভোল্টেজ ভোট কি বহরমপুরে নতুন ? ভোটে কলম ধরলেন সাংবাদিক প্রাণময় ব্রহ্মচারী।

 

১৯৯৬ সাল। সঙ্গী  সাংবাদিক মিলন মন্ডল আর তাঁর “এম এইট্টি”। অফিসের নির্দেশে   আনকমন, এক্সক্লুসিভ রসালো স্টোরির খোঁজে বহরমপুরে (Berhampore)  চক্কর  কাটছি ।  সদ্য সদ্য বহরমপুর সুইমিং ক্লাবের গলিতে শংকর পালের আপ্ত সহায়ক কানন গাঙ্গুলীর বাড়ি থেকে  ঘুরে এসেছি। এই বাড়ির বাইরেই ২০২২ সালে ২ মে সুতপা চৌধুরী হত্যাকান্ড ঘটেছিল ।কানন গাঙ্গুলী   তিনি দেখালেন,  সামনের  বাড়িতেই বহরমপুর লোকসভার তারকা প্রার্থী  সিদ্ধার্থ শংকর রায় ( Siddhartha Shankar Ray)  আগামীকাল থেকে  ঘাঁটি গেড়ে  ওয়াররুম বানিয়ে  বামেদের লাল দুর্গ বহরমপুর লোকসভা দখল করার ছক কষবেন !

আরও পড়ুনঃ INDIA Alliance: অধীর, অভিষেক তরজায় কেন্দ্র সেই ইন্ডিয়া !

কথায় কথায়  আমরা লালদিঘীর সামনে। মিলনদা হঠাৎ  তার বাইকের  ব্রেক কষে একদল বাম যুব কর্মীর দেওয়াল লিখন  মন দিয়ে  দেখতে থাকলেন ! ধীরে ধীরে শোলে সিনেমার সেই বিখ্যাত  সংলাপ দেওয়ালে  লেখা হতে থাকল,  “বেটা শো যা ,নেহিতো বহরমপুর মে গব্বর সিং (সিদ্ধার্থ শংকর)  আ য়ায়েগা!” ( সাথে  সিদ্ধার্থ শংকর রায় কে গব্বর সিং ভিলেন বানিয়ে  কার্টুন চিত্র)  । মিলন দা ক্যামেরা বের করে গোটা কয়েক  ছবি  তুলেই সোজা  টেক্সটাইল মোড়ে বিএসএনএল অফিসে  এসে The Asian age এর তদানীন্তন ব্যুরো চিফ দিব্যজ্যোতি বসু কে ছবির কথা জানালেন।  তিনি এই প্রতিবেদককে  এসটিডির ফোনের ওপার থেকে  নির্দেশ দিলেন,  ” যা যা  দেখলি তার আঁখো  দেখা হাল দুপাতা ফ্যাক্স  করে পাঠিয়ে দে। আর ফটোর রিল টা য়েন রাত ৮টার মধ্যে অফিসে  পৌঁছানো চাই” ।  খস খস করে  দুপাতা লিখে  ফ্যাক্স পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।  আর মিলন দা দুপুর  ২.৩৬’এর   লালগোলা প্যাসেঞ্জার  ট্রেনের গার্ডের হাতে ফটো রিল ধরাতে ছুটলেন।

তখন  সকাল দশটায় বহরমপুরে খবরের কাগজ আসতো। পরদিন  কাগজ ও দেখার সময় পাইনি। কে জানতো কংগ্রেসের মানুদা, মায়াদি  বহরমপুরে পা ফেলার আগেই সবখবরের কাগজ হস্তগত করে ফেলেছেন ।  আমার লেখা আর মিলনদার ছবি মিলে   স্পেশাল স্পটলাইট স্টোরি হয়ে গিয়েছে।    আমরা কয়েকজন সাংবাদিক চুপিচুপি  ওনার বাড়ির সামনে সেই সাত সকাল থেকেই  হত্যে দিয়ে  দাঁড়িয়ে আছি। ওনার  দর্শনের আশায় ।  সিদ্ধার্থ জায়া মায়া রায়  বললেন   “প্রেসের কারা কারা আছেন  তারা বাদে সবাই মিলে বাইরে অপেক্ষা করুন” ।   আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে নাম আর কাগজের নাম জানতে চাইলেন ।

 

নাম আর কাগজের নাম  বলতেই রেগেমেগে আগুন হয়ে বললেন, “ মানু, দ্যাখো  দ্যাখো এই ছেলেটাই  তোমাকে  গব্বর সিং ভিলেন বানিয়েছে, ওর এডিটর এমএজ আকবরকে   ( M J Akbar)  কে কমপ্লেন করে ওর চাকরি খেয়ে নিয়ে ওকে পুলিশে দাও।  এত বড় সাহস !”।

সিদ্ধার্থ শংকর রায় তাঁকে   শান্ত করতে চেষ্টা করলেন, আর বলেছিলেন,  “কে জয় আর কে বীরু নিজের চোখেই দেখবে বহরমপুরের মানুষ !  কতো মানুষ আমাদের  ওয়েলকাম জানানোর জন্য অপেক্ষা করে আছে, ওরা নিজের চোখেই দেখবে ও লিখবে” ! তারবপর বললেন,  “জ্যোতির সাধের লাল বাংলার লাল  দুর্গ খালি ভেঙে  পড়ার  অপেক্ষা।  আমি তো  আইনের লোক,  তাই সব আইন মেনেই হবে”।

কথা শেষ হতে না হতেই  তার বিদেশি বাতানুকূলে গাড়িতে আমাদের  চাপিয়ে নিলেন।   সেই প্রথম তারকা প্রার্থীর ভোট  কভার করা । বাস্তব  অর্থেই তিনি  ছিলেন তারকা প্রার্থী   সিদ্ধার্থ শংকর রায়।  কি ক্যারিয়ার !  বিলেত ফেরত সুপ্রিম কোর্টের  ব্যারিস্টার ,   প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। নিজে প্রাক্তন  মুখ্যমন্ত্রী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের দৌহিত্র,  একদা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা । সেবার   সারা  বাংলা তাকিয়ে ছিল  বহরমপুরের দিকে।  “ উনি কি বহরমপুরে আরএসপির জয়য়াত্রা রুখতে  পারবেন ?”,   এটাই  ছিল তখন   চায়ের দোকানের একমাত্র চর্চা ।

আরও পড়ুনঃ Humayun Kabir: হুমায়ুনের মূষিক প্রসব

কিন্তু  অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তখন ও বহরমপুরে ভোটের একটা ট্রেন্ড ছিল ।  বিধানসভায় কংগ্রেস আর লোকসভায় আরএসপি  বরাবর জিতে আসতো । সেই  সময় বর্ধমান  জেলার কেতুগ্রাম ছিল  বহরমপুর লোকসভার অধীনে ।   সেই  লালদুর্গের শক্তপোক্ত  বাম  সংগঠনের  সাহায্যে   ত্রিদিব চৌধুরী থেকে ,ননী ভট্টাচার্য, প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়রা  বারবার  জেতার  অভ্যাস  করে ফেলেছিলেন ।  কিন্তু  সিদ্ধার্থ শংকর রায়  সব চেষ্টা করে প্রচারে ঝড় তুললেও ব্যালটে কিন্তু  তার  প্রতিফলন পড়েনি ।

কেতুগ্রামে লাল টি শার্ট পড়ে ছাগলের বাচ্চাকে আদর করার ছবি বা রংবেরঙের খাদির হাফহাতা শার্ট গায়ে দিয়ে,   কলকাতার চিত্র সাংবাদিকদের বায়না মিটিয়ে  হাসি হাসি মুখে  স্ট্র দিয়ে ডাবের জলে চুমুক দেওয়ার  পোজ দিয়েও শেষ রক্ষা  হয়নি।

সেই সময় প্রয়াত গায়ক অজিত পান্ডের নেতৃত্বে লোপামুদ্রা মিত্র প্রমুখ গায়ক গায়িকারাও  ওনার  জরুরী অবস্থার কালো দিনগুলো  স্মরণ করিয়ে  গান গেয়ে লোক জড়ো করতেন ।

বহরমপুর লজ হোটেলে তো তদানীন্তন ছাত্রপরিষদ নেতা বর্তমানে সদ্য তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগী বিজেপি নেতা তাপস রায়দের সাথে বামেদের   গণসংগীত টিমের বাকযুদ্ধ  শুরু  হয়েগিয়েছিল।  তবে তৎকালীল সোমেন মিত্র টিমের যুব  কংগ্রেস নেতা মদন মিত্রদের হস্তক্ষেপে সম্মুখ সমর থামে । তবে  তখন হাই ভোল্টেজ মিডিয়ার প্রচারে পাত্তা না পাওয়া   প্রমথেশ মুখোপাধ্যায় কিন্ত বামেদের শক্তপোক্ত  সংগঠনের কাধে ভর দিয়েই ৩, ৮৭,৫৪৯ ভোট ( ৫২.৩%) পেয়ে তারকা  কংগ্রেস প্রার্থী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়কে প্রায় একলাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বহরমপুরের  বাম দুর্গ রক্ষা  করেছিলেন ।   বেশ মনে আছে জেলা প্রশাসনিক ভবনে  অফিস  গণনা কেন্দ্রে  গভীর রাতে  হারার  পরও  হাসি মুখে   তিনি  বলেছিলেন,   “ আর ব্যান্ড এইড দিয়ে  কি ভেতরের  রক্ত ক্ষরণ বন্ধ  হবে ! তোমরাই আমার পেছনে লেগে ডোবালে”। তার কিছু আগেই হাতে খোঁচা লেগে কিঞ্চিত রক্তক্ষরণও হয়েছি তাঁর।

আর সেই  ১৯৯৬ সালেই সিপিএমের ভিয়েতনাম বলে একদা লোকমুখে প্রচলিত  নবগ্রাম বিধানসভায়  রেকর্ড ভোটে জিতে অধীর চৌধুরীর বাংলায় তার  রাজনৈতিক কেরিয়ার  শুরু করেছিলেন। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় ভোটযুদ্ধ লড়েছেন অন্তরালে থেকেই।  সেই  তিনিই  ১৯৯৯ সালে সেই প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়কেই হারিয়ে এখনো  পর্যন্ত অপরাজিত ইনিংস খেলে চলেছেন।

বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী নির্মল সাহা বা তৃণমূল কংগ্রেসের   ক্রিকেট তারকা প্রার্থী ইউসুফ পাঠান কি   অধীর চৌধুরীর টানা ২৫ বছরের সাংসদ ইনিংস ভোটের ক্রিজে আউট  করতে পারবেন ? চব্বিশের ভোটে এটাই পড় প্রশ্ন।তবে  এই কোটি টাকার প্রশ্নের  উত্তর পেতে হলে  বলা যায়, সময় দেবে উত্তর। তবে ভোটের হাওয়ায় ফিরে আসছে ১৯৯১’এর স্মৃতিও।

 

সেটা  ১৯৯১ সাল।  তখন  একসাথে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন  ঘোষণা  হয়ে গিয়েছে।   আমারও সবে সাংবাদিকতায় সদ্য  হাতেখড়ি হয়েছে।  সাপ্তাহিক  ওভারল্যান্ড পত্রিকায় এসাইনমেন্ট  পেয়ে কলম চালিয়েছি সাগরদিঘি নিয়ে।  “ সাগরদীঘি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের  আশায়  দিন গুনছে মুর্শিদাবাদ”,  শীর্ষক লেখা  লিখে  জীবনে  প্রথমবার ৪০ টাকার  সম্মান দক্ষিণাপ পেয়েছি।  সেই  চেক  ভাঙ্গাতে ২০০টাকা  দিয়ে  খাগড়া ইউনাইটেড  ব্যাংকে  একাউন্ট  খোলা  হয়েছে।  সাথে  মুর্শিদাবাদ  সন্দেশে ও লেখা  চলছে। এদিকে  সবার টিপ্পনী,  “ঢাকের  দায়ে মনসা বিক্রি”। কিন্তু  সেদিন  মুর্শিদাবাদ  সন্দেশের  সম্পাদক বাচ্চুদা ( সত্য রঞ্জন বক্সী)  ও অন্যতম  প্রাণপুরুষ  অপুদা ( অপুর্ব ভট্টাচার্য)রা কিন্তু  আমায় উৎসাহিত  করেছিলেন। তখন  সাংবাদিকতা তাও আবার  সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখে  টাকা  পাওয়া  বিরলতম ঘটনা।

সেই   ১৯৯১ সালে  দেওয়ালে দেওয়ালে কংগ্রেস লিখেছিল,  ” লোডশেডিং এর সরকার / জ্যোতি বসুর  সরকার / আর নেই দরকার “।  ছড়া  লিখে  আসরে নেমে পড়েছিল কংগ্রেস।  ওনাদের  বক্তব্য ছিল  ওভারল্যান্ড ঠিক জায়গায় ধরেছে । কৃষিপ্রধান  মুর্শিদাবাদে সাগরদীঘি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র  হলে বিদ্যুৎ এর ঘাটতি মিটিয়ে  জেলার উন্নয়নের চেহারাটায় পাল্টে যাবে ।  এই  ১৯৯১ সালেই   অধীর চৌধুরীর ভোটের হাতে খড়ি হয়েছিল ।

কংগ্রেস বহরমপুরের রবিনহুড নামে খ্যাত  অধীর চৌধুরীকে সিপিএমের  ভিয়েতনাম  নামে লালদুর্গ ভাঙতে নবগ্রামে মনোনয়ন দিয়েছেম । তাই নিয়ে  কংগ্রেসের সোমেন মিত্র, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোষ্ঠীর  বিরোধ তুঙ্গে।  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  আত্মহত্যার হুমকি দিলেও অধীরের মনোনয়ন ঠেকাতে  পারেননি । মান্নান হোসেন  জঙ্গিপুর লোকসভায় দাঁড়িয়েছেন ।  সেবারে বহরমপুর লোকসভায় আরএসপির ননী ভট্টাচার্য বনাম কংগ্রেসের  কুমার দীপ্তি সেনগুপ্তের  লড়াই।  মুর্শিদাবাদে সিপিএমের  সৈয়দ মাসাদুল হোসেন  বনাম কংগ্রেসের আলি হোসেন  মন্ডলের লড়াই।  আর সেবার  বিধানসভায়  বহরমপুরে কংগ্রেসের  শংকরদাস পালের কাছে  হেরে যাওয়ার ভয়ে বহরমপুর  ছেড়ে  বড়ঞায় দাঁড়িয়েছিলেন আরএসপি’র   দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ।

মুর্শিদাবাদে ছিলেন  ফরোয়ার্ড ব্লক ছায়া ঘোষ । সিপিএমও একধাক্কায় ডোমকলের টানা  ১৫ বছরের দাপুটে  মন্ত্রী আব্দুল বারিকে মনোনয়ন না দিয়ে  আনিসুর রহমানকে জিতে এনেছেন। জলঙ্গীতে ইউনুস  সরকার, সাগরদীঘিতে পরেশ নাথ দাসদের মনোনয়ন দিয়ে  জিতিয়ে  আনে সিপিএম ।  এই প্রতিবেদকের কিন্তু  হাইভোল্টেজ নবগ্রাম বিধানসভা সহ জেলার  কোনো  ভোটেরই খবর  কভার করা শেষ  পর্যন্ত  কপালে জোটেনি ।  কারন  ঠিক  ভোটের আগেই  পা ভেঙে  পায়ে প্লাস্টার বেধে টানা আড়াই মাস শয়্যাশায়ী হয়ে গৃহবন্দি থাকতে  হয়েছিল ।   কাজেই  সেই  অর্থে ১৯৯৬ সালের  একসাথে লোকসভা ও বিধানসভার হাইভোল্টেজ ভোটে  হাতে কলমে কাজ করা ও ভোট প্রক্রিয়া  চাক্ষুষ করা  জীবনের  পরম প্রাপ্তি ।  তবে  সে অন্য  কোনো  সময়ে বলা যাবে।  ( ক্রমশ)

মতামত লেখকের নিজস্ব।  প্রাণময় ব্রহ্মচারী বিশিষ্ট সাংবাদিক।