Politics of Murshidabad District: গ্রেফতার করা হয়েছিল অধীকে তারপর হ্যাটট্রিকও

Politics of Murshidabad District একশ্রেণীর  কংগ্রেস নেতা, পুলিশ  প্রশাসনের পরোক্ষ সহায়তায় মুর্শিদাবাদে  অধীর চৌধুরীর ডানা ছাঁটতে  তার বিরুদ্ধে  “ইন্দিরা রাজীব মঞ্চ”  গড়ে ওঠে। ২০০৫ সালের শেষদিকে দিল্লি থেকে  অধীর চৌধুরীকে  জোড়া খুনের মামলায় গ্রেফতার করা হয় । কী হয়েছিল তারপর ? লিখলেন সাংবাদিক প্রাণময় ব্রহ্মচারী।

 

Politics of Murshidabad District ২০০৯ এর লোকসভা ভোটে বহরমপুরে অধীর চৌধুরীর হ্যাটট্রিক করেন। সেবার   মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস ফের  “তিনে তিন” করে কংগ্রেস । ১৯৯৯, ২০০৪ সালের থেকেও প্রায়  ডাবল মার্জিনে ১ লক্ষ  ৮৬ হাজার ৯৭৭ ভোটে জিতে  অধীর চৌধুরী Adhir Ranjan Chowdhury  বহরমপুর লোকসভা নির্বাচনে হ্যাটট্রিক করেন ।  পাশাপাশি আরএসপির প্রমথেশ মুখোপাধ্যায় ও সেবার “হারের হ্যাটট্রিক”  করেছিলেন ।  প্রণব মুখোপাধ্যায় Pranab Mukherjee ও ১ লাখ ২৮ হাজার ১৪৯ ভোটে জিতে জঙ্গীপুর পৌরসভার অপরাজিত চেয়ারম্যান,  জনপ্রিয় সিপিএম নেতা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যকে হারান।   অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ লোকসভা আসনে কংগ্রেসের মান্নান হোসেন ১৯৯১ থেকে   সিপিএমের জাদরেল অপরাজিত মন্ত্রী আনিসুর রহমানকে  ৩৫ হাজার ৬৪৭ভোটে হারিয়ে নিজের রাজনৈতিক জমি শক্ত  করেছিলেন।

সেবার ভোটে মুর্শিদাবাদে ফের “অধীর ম্যাজিক”  কাজ  করেছিল একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা ।  তবে সেদিনের রাজনীতির অন্দরমহলে কান পাতলে  শোনা  যায় ২০০৪ সালে  মুর্শিদাবাদে তিনে তিন  আসন জিতিয়ে  অধীর চৌধুরীকে একই সাথে  দলের দিল্লির নেতৃত্বের যেমন প্রিয়পাত্র  হয়েছিলেন তেমনই  তার দ্রুত রাজনৈতিক উত্থান  দলেরই একশ্রেণীর  নেতারা মনেপ্রাণে  মেনে নিতে পারেননি। পাশাপাশি তাকে  তদানীন্তন  রাজ্যের বাম শাসকদলের ও রোষানলে পড়তে হয়েছিল । তখনকার মুর্শিদাবাদ জেলার  কংগ্রেস এর ভরকেন্দ্র একদিকে অধীর চৌধুরী ,মান্নান হোসেন  ও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ত্রিধারায় আবর্তিত হয়েছিল।

একশ্রেণীর  কংগ্রেস নেতা, পুলিশ  প্রশাসনের পরোক্ষ সহায়তায় মুর্শিদাবাদে  অধীর চৌধুরীর ডানা ছাঁটতে  তার বিরুদ্ধে  “ইন্দিরা রাজীব মঞ্চ”  গড়ে ওঠে। ২০০৫ সালের শেষদিকে দিল্লি থেকে  অধীর চৌধুরীকে  জোড়া খুনের মামলায় গ্রেফতার করা হয় । তখন  জেলার তৃণমূল স্তরের কর্মী, নেতা,সমর্থকগণ রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে অধীর চৌধুরীর সমর্থনে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুললেও অপর  দুই সাংসদও বেশ কয়েকজন বিধায়কদের   রহস্যজনক ভাবে  নিজেদের গুটিয়ে রেখে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় ।

জামিনে মুক্তি পেয়েই অবশ্য  অধীর চৌধুরী স্বমূর্তি ধরেন ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও তার রাজনৈতিক গুরু সোমেন মিত্রর প্রকাশ্য বিরোধিতা করে  ২০০৬ বিধানসভা ভোটে কান্দিতে অতীশ সিংহের বিরুদ্ধে  অপুর্ব সরকার ( এখন  অবশ্য মুর্শিদাবাদ তৃণমূল কংগ্রেস জেলা  সভাপতি)  বহরমপুরে মায়ারাণী পালের বিরুদ্ধে মনোজ চক্রবর্তী, হরিহরপাড়ায় নিয়ামত সেখদের বিরুদ্ধে গোঁজ  প্রার্থী খাড়া   করে তাদের জিতিয়ে  আনেন ।

নিয়ামত সেখও হারেন কিন্তু ২০০৬ বিধানসভা ভোটে  কংগ্রেস  মুর্শিদাবাদে  শোচনীয়  ফল করে। কংগ্রেসের প্রতীকে কেবল ফরাক্কা, লালগোলা, নওদা ও বহরমপুর ও কান্দিতে অধীর চৌধুরীর নির্দল  প্রার্থীগণ সহ মাত্র ৫ জন জেতেন আর শাসক  বামফ্রন্ট  মোট ১৯টি আসনের   মধ্যে ১৪ টি আসন দখল করে। এদিকে ২০০৬ সালের অক্টোবরে   অধীর চৌধুরীর পারিবারিক দুর্যোগ নেমে আসে ।  নিজেকে স্বেচ্ছায় ঘর বন্দি করে ফেলেন তিনি।   অবশ্য  প্রণব  মুখোপাধ্যায় দিল্লি থেকে ছুটে এসে  অধীর চৌধুরীকে ফের রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনেন ।

Politics of Murshidabad District  লোকসভা ভোটের আগের বছর  ২০০৮ সালে ফের বামেরা মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ পুনরুদ্ধার করলেও  ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদে তাদের শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছিল ।  এর কারণ  হিসেবে বলা যেতে পারে, অবশ্য সারা দেশের রাজনৈতিক   প্রেক্ষাপটে দিল্লির দরবারি নাটকের দ্রুত  কুশীলব পরিবর্তন, লোকসভা ও বিধানসভার  সীমানা পুর্নবিন্যাস,  সিঙ্গুর,নন্দীগ্রামের জোড়া আন্দোলনের ফলে  পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক  পটপরিবর্তন, সিপিএম ও বামফ্রন্টের দ্রুত  রক্তক্ষরণ ।   ৩৪ বছরের  বামদুর্গ পতনের ইঙ্গিত ও মিলতে শুরু করেছিল সেবারই। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের  ৮ জুলাই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে “জুলাই ক্রাইসিস” তৈরি হয়েছিল।  কী  সেই  জুলাই ক্রাইসিস?

তদানীন্তন সিপিএম সম্পাদক প্রকাশ করাতের নেতৃত্বে কেন্দ্রের ভারত সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  পারমাণবিক চুক্তির প্রতিবাদে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে  বামেরা   সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় ।   কিন্তু বামেরা   মনমোহন সিংহ মন্ত্রীসভার পতন ঘটাতে পারেনি। বরং তৃণমূল ও কংগ্রেস কাছাকাছি আসে।  তৃণমূল কংগ্রেস, অনান্য  অকংগ্রেসী, অ বিজেপি ছোট ছোট  দলগুলিকে   কংগ্রেস ইউপিএ জোটে ভিড়িয়ে  দিল্লির চানক্য প্রণব মুখোপাধ্যায় শুধু  প্রথম  ইউপিএ সরকারের পতন ঠেকিয়ে ক্রাইসিস ম্যানেজার তকমা জেতেন।  সোনিয়া গান্ধীর কাছ থেকে বাহবাও  কুড়িয়ে ছিলেন প্রণব।  শুধু তাই নয় ।    পশ্চিম বাংলা সহ সারা দেশে বাম দুর্গ ও প্রায় তছনছ করে দিয়েছিলেন।  লোকসভা অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে  বহিস্কার করে ।

সিপিএমকে  পশ্চিমবাংলায় ৪২টি মোট আসনের মধ্যে  মাত্র ১৫ টি আসনে আটকে রেখে প্রকাশ  করাতদের  হাতে “ রেড নোটবুক আর পেন্সিল”  ধরিয়ে দিয়েছিল  মমতা  প্রণব মুখোপাধ্যায় জুটি। তৃণমূল কংগ্রেস,কংগ্রেস, এসইউসির ( ১৯ তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস ৬, এসইউসি ১  জোট ২৬ টি আসন) মোট ২৬  জেতে এই জোট   ।

অপরদিকে  দার্জিলিং আসনটি বিজেপির যশবন্ত সিংহ জিতেছিলেন । ২০০৯ সালে লালগোলার ছাগলহাটা ময়দানে  প্রণব মুখোপাধ্যায়ের  সমর্থনে সোনিয়া গান্ধীর ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় অধীর চৌধুরী,  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক মঞ্চে হাজির থাকলেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দুরত্বের বরফ  গলেনি।

Politics of Murshidabad District  যদিও  তৃণমূল কংগ্রেস মুর্শিদাবাদে তিন প্রার্থী  সহ রাজ্যের  ১৪ টি আসনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী  না দিয়ে  সমর্থন করার পুরস্কার পেয়েছিল।    দ্বিতীয়  ইউপিএ সরকারে   মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে  রেলমন্ত্রী করা হয়। সেবার     ডিলিমিটেশন ও ছিল মুর্শিদাবাদে   কংগ্রেসের ম্যাজিক রেজাল্ট করার অন্যতম ফ্যাক্টর । পাশাপাশি বাংলায় সঙ্গীসাথী হীন  বিজেপির বেশির ভাগ  ভোট সেবার  কংগ্রেসের ভোট বাক্সেও জমা পড়ে।   এতদিনের বহরমপুর লোকসভার মধ্যে বর্ধমানের সিপিএম গড় হিসেবে পরিচিত  কেতুগ্রাম বিধানসভা ডিলিমিটেশনের ফলে বহরমপুর লোকসভা থেকে  বাদ চলে যায়।  তার বদলে ২০০৯ এর ভোটে  নতুন রেজিনগর বিধানসভা অন্তর্ভুক্ত  হওয়ায় অধীর চৌধুরী  এডভ্যান্টেজ পায় ।  আর বামেদের ডিসএডভ্যান্টেজ শুরু হয়।  অপরদিকে জঙ্গিপুর লোকসভার  ফরাক্কা ও শমশেরগঞ্জ  মালদহ দক্ষিণ লোকসভায় যুক্ত   হয়।    মুর্শিদাবাদ লোকসভায় নতুন রাণীনগর বিধানসভা যোগ  হওয়ায় কংগ্রেসের পালে বাতাস লাগে ।    তবে  দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের “সেকেন্ড ইন কম্যান্ড”  হয়েই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ফের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।

সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে  কংগ্রেস হাইকম্যান্ড পুনরায় প্রধানমন্ত্রী পদে মনমোহন সিংহের  উপরেই আস্থা  রাখেন।  শোনা যায়  প্রধানমন্ত্রীর পদ চিরকাল অধরা থেকে  যাওয়ায়  নিজের বৃত্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত  হননি প্রণব মুখোপাধ্যায়।  তাকে  প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে অবসর নেওয়ার কথা বলতে শোনা য়ায়। অবশেষে ২৭ জুন ২০১২  সত্যিই  কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও জঙ্গিপুরের সাংসদ  পদ  থেকে পদত্যাগ করেন ও ২৫ জুলাই  দেশের  সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত  হন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

দ্বিতীয়  ইউপিএ সরকারে  কংগ্রেস – তৃণমূল কংগ্রেসের ” মধুচন্দ্রিমা ” শেষ হয় দ্রুতই।  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  তার সমর্থন প্রত্যাহার করেনও ৬জন তৃণমূল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ১৮ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। পাল্টা রাজ্য  মন্ত্রীসভা থেকে কংগ্রেসের  ৬ জন মন্ত্রী ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ পদত্যাগ করেন।  প্রণব মুখোপাধ্যায়  প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে চলে যাওয়ায় সেবার  কিন্তু  ২০১২র ক্রাইসিস  কেউই মেটাতে পারেননি। এই আবহে জঙ্গীপুর লোকসভায় ফের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও প্রনব পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় সাংসদ নির্বাচিত হন । এদিকে  ২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর  অধীর চৌধুরী কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ( রাষ্ট্রমন্ত্রী) হন ।

পুনশ্চ : ২০০৯ লোকসভা ভোটের সালতামামি লিখতে আগেও পরের গুলি ঘটনাবলী প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় বাধ্য হয়েই তুলে ধরা হলো। (ক্রমশ)

লেখক সাংবাদিক। মতামত নিজস্ব।