প্রবীণ বনাম নবীনদের চোখে কতটা পাল্টেছে বহরমপুরের পুজো!

ঋত্বিক দেবনাথ, বহরমপুরঃ শরতের উৎসব, শারদ উৎসব। মাঠের ধারে সাদা কাশফুল। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। সাথে ঢাকের বোল ও পুজো পুজো গন্ধ। এই তো বাঙালির মহোৎসব। তবে কেমন যেন পাল্টে গেছে ছবিটা আক্ষেপ প্রবীণদের। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে থেমে নেই কিছুই। আজকের গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর যুগে যেন ফিকে হয়েছে উৎসবের সাবেকিয়ানা। কিন্তু উৎসব তো উৎসবই। সব কিছুর মতো উৎসবের ধরণ পাল্টে গেলেও আনন্দ তো আনন্দই থাকে।

কালের সরণি বেয়ে দুর্গাপুজো রাজবাড়ি জমিদার বাড়ির আঙিনা ছেড়ে বেরিয়ে এল সবর্জনের কাছে অর্থাৎ ‘সর্বজনীন’ হয়ে উঠল এই দুর্গাপুজো। বাঙালি সাবেকি পুজো প্রথাকে যেমন সাদরে গ্রহণ করেছিল, তেমনি অধুনাকালের এই বদলগুলোকেও আগলে ধরেছে ভালোবেসে। কারণ এ তো কেবল পুজা নয়, উৎসব আসলে এক মহামিলনের উৎসব। উৎসব মানেই ঘড়ে ফেরার একটা উন্মাদ।

দুর্গা পুজো মানেই নারকেল ও গুড়ের নাড়ু। সাথে গরম গরম নিমকি। সাথে খই ও মুড়কিও বাদ যাবে কেন। মনে পরে যায় চিন্ময় চ্যাটার্জির লেখা গান ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’। এই পুজোর কদিন সবকিছু একপ্রকার ভুলেই যাওয়া। খালি মনেপ্রাণে পুজোর গন্ধ। নতুন হোক কিংবা পুরনো, ভালো জামা-কাপড় পরে মনখুলে ঠাকুর দেখা এবং ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়া। এসবের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে অধ্যাপক বিষাণ গুপ্ত বলেছেন, আজও শিউলি ফোটে, শিউলি ঝড়ে পরে কিন্তু কুড়াবার লোক নেই। বিজয়া দশমীর স্মৃতি চারণ করে তিনি বলেন, আজকালকার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে।

কিন্তু এইসমস্ত ব্যপারগুলো সময়ের সাথে সাথে কেমন মলিন হয়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে পুজো নিয়ে উৎসাহ। কেন? যত সময় যাচ্ছে মানুষ ততই ব্যাস্ত হয়ে পরছে। এছাড়াও পাল্টাচ্ছে মানুষের চাহিদা এবং কোথাও গিয়ে পুরনো সংস্কৃতিকেও আমরা ভুলতে বসেছি। এবং যার ফলে ধীরে ধীরে পুজোটা হয়ত কেবলই বিনোদনে পরিণত হচ্ছে। যার দরুন মানুষের যে আবেগ জড়িয়ে দুর্গা পুজার সাথে তা কমবেশি টলমল করেছে। বিশিষ্ট চিকিৎসক ও প্রবীণ নাগরিক ডাঃ নির্মল সাহা জানান, “পুজোর নাম করে উৎসবকে ভুলিয়ে দেওয়া এবং সংস্কৃতিটাকেই পাল্টে দেওয়া। এটি তলে তলে একটি ষড়যন্ত্র। আমরা ছোট বেলায় দেবদারু গাছ দিয়ে গেট করতাম। দেবদারু গাছের ওই দেবতা আর নেয়। তার জায়গাতে এসেছে দারু বা মদ।”

শহর বহরমপুরে প্রাচীন কাল থেকেই বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব দেখা যায়। এই শহর যখন ব্রহ্মপুর নামে পরিচিত ছিল তবে থেকেই দুর্গা পুজা, চণ্ডী পাঠ এসব ঘটা করে পালিত হত। এবং সেই সময় থেকেই দেখা যেত পারিবারিক বাড়ির পুজোর চাকচিক্য। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা পরিণত হয় বারোয়ারি পুজোতে।

কিন্তু কোথাও কোথাও এই বারোয়ারি বা বলা চলে সার্বজনীন পুজোর ফলে অনেক মানুষের কাজ তৈরি হয়েছে। বিশেষত দিনমজুরদের জন্যে। কারণ বর্তমান সময়ে যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হাজারো মানুষের কাজ কমিয়ে দিচ্ছে। সেখানে আজকের দিনে দাড়িয়ে হাতে করে বাঁশ কেটে, দড়ি বাঁধা। সম্পূর্ণ একটা কাঠামো বানানো। এইসব কাজ কিন্তু মানুষের হাত ছাড়া করা খুব মুশকিল। এবং এত দুর্গা পুজা হয় বলেই মৃৎশিল্পীরাও ভালো কাজের অর্ডার পান। এমনটাই দাবি করছেন নতুন প্রজন্মের নাগরিক দীপ শঙ্কর ভট্টাচার্য।

পুজো সবার, সর্ব ধর্ম নির্বিশেষে দুর্গা পুজো পালিত হয়। এবং কোথাও গিয়ে অর্থনীতির বৃহদাংশ এই দুর্গা পুজার সাথেও জড়িয়ে। সত্যি বলতে জমিদারী পুজো এবং এই সার্বজনীন পুজোর মধ্যে কোনদিনই কোন তুলনা হয়না। দুটি ভিন্ন ধরনের ভিন্ন স্বাদের পুজা। প্রতিটার নিজেস্ব একটা ভালোলাগা জড়িয়ে রয়েছে। এক শ্রেনির মানুষের রোজগারের একটি মূল উৎসও এই দুর্গা পুজা। তাই উৎসব হোক সবার। এই আশা নিয়েই শতাব্দীর পর শতাব্দী, যুগের পর যুগ বেঁচে থাকুক বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, যেভাবে থেকেছে এতকাল।