বসন্তের ফাগে রাঙা হবে কে? ব্যক্তি না সমষ্টি?

স্নেহাংশু চট্টরাজ, সাগরদিঘিঃ সূর্য অস্ত যাওয়ার গতিবেগের চেয়ে অনেক ধীরে, আরাম- আয়েশে মত দিতে বুথে গিয়েছিলেন সাগরদিঘি ব্লকের বাসিন্দারা, সোমবার। দিনের শেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত এদিনের ভোটের হার ৭৫.১৮ শতাংশ। মত দান পর্বে কোথাও ঘটেনি কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা। প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাও মতদান পর্ব নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন কমিশন আর কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দরাজ শংসাপত্র দিয়েছেন বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। এই দুই সংস্থার প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন বিজেপি’র শীর্ষ নেতারাও। তৃণমূল মুখে না বললেও দুই সংস্থার ভূমিকা নিয়ে তেমন দুর্নামও করেনি। আগামী বৃহস্পতিবার, মার্চের দু-তারিখেই জানা যাবে তৃণমূলের প্রয়াত সুব্রত সাহার উত্তরসূরি হলেন কে?

তবে এই অকাল নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়া ইস্তক উত্তর মুর্শিদাবাদের এই ব্লকের ১১টি অঞ্চলের মানুষ ঘুরপাক খেয়েছেন প্রতি সন্ধ্যায়, সকালে, মাঠে খাটার পরে, বিড়ি বাঁধার অবসরে এমনকি ভিন রাজ্যে কংক্রিটের দেওয়াল গাঁথতে গাঁথতে নির্বাচন নিয়ে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় ডুব দিয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলো। অনেক ভেবেচিন্তে এদিন তাঁরা মত দিয়েছেন। কেউ সিদ্ধান্ত না নিতে পেরে পিছিয়ে গিয়েছেন। কেউ সময়ে জমতে পারেননি বলে অধরা থেকেছে তার মত দান।

তবে জনগণনার হিসেবে মুর্শিদাবাদের এই অংশে সংখ্যালঘু মুসলিমরাই সংখ্যাগুরু। মোট জনসংখ্যার প্রায় দেড় লক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বাস করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৪ বছর এই বিধানসভায় বামফ্রণ্টের বড় শরিক সিপিএম(আই)রাজত্ব করেছে এদের সঙ্গে। অথচ সেই সময়ে কৃষিপ্রধান সাগরদিঘির বাসিন্দাদের আয়ের ভিন্ন উৎস দেখাতে পারেননি তৎকালীন শাসক দল। আবার এমনও হয়নি কৃষিজীবীর ঘরে ঘরে উথলে উঠেছে নবান্নের ধান। মানুষ ভগবান ভরসায় দিন কাটিয়েছেন হয় বিড়ি বেঁধে না হয় সস্তার শ্রমিক হয়ে। প্রাপ্তি বলতে ২০০৮ সালে সাগরদিঘি থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মণিগ্রামে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিস্থাপন। তখন সিপিএমের বিদায় বেলা। সেবার তিনশো মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট বসেছিল এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। তাতে মানুষ ভোলেনি। ২০১১ সালে রাজ্যের প্রবল বাম বিরোধী হাওয়ায় মুর্শিদাবাদে জোড়াফুল ফোটে একমাত্র এই সাগরদিঘিতেই। তৃণমূল ঝড়ে এরপর আর থামতে হয় নি সদ্য প্রয়াত সুব্রত সাহাকে। রাজ্যের পালাবদলের পর পাঁচশো মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট বসেছিল ২০১৫ ও ২০১৭ সালে এই মণিগ্রামে। ছ’শো মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বসানোর কাজ চলছে। কবে শেষ হবে তা জানা যায়নি এখনও। তবে তাতে মণিগ্রামের বেহাল দশা আমূল বদলেছে তা নয়, কিন্তু তাতে প্রলেপ যে পড়েছে তা অবশ্য বলা যায়।
একুশের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মুর্শিদাবাদ থেকে ২০টি আসন পেয়েছেন। ২০১৯ সালের পর থেকে এই দেশে জাঁকিয়ে বসেছে গেরুয়া সংস্কৃতি। ধর্মের নামে নিরপেক্ষ থাকা এদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মুখোশও খুলে গিয়েছে, এটাও সত্যি। এনআরসি, সিএএ দুই অস্ত্রে শান দেন পদ্ম নেতারা। বিশেষ করে ভোট আসলে। অথচ ওই দুই বিষম বস্তু কী এবং কেন তা প্রয়োগ করতে মরিয়া বিজেপি, তা কিন্তু ও দলের নেতারা খোলসা করে বলেন না কখনও। এরফলে ক্ষমতার বড়াই হয়, অধরা থাকে উন্নয়ন, রাষ্ট্রের কল্যাণ। একুশেও সেই ঝড়ে রাজ্যকে বেসামাল করেছিল বিজেপি। হিন্দু না ওরা মুসলিম এই তত্বে জোড়াফুলও টলেছিল। সংখ্যালঘুদের খুঁটি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

এ রাজ্যের সংখ্যালঘুরা একসময় বামেদের ভরসা করতো। ক্ষমতার হাত বদলে তাঁরাও ডাল বদলেছে। এখন তৃণমূল তাঁদের ভরসা। মণিকোঠায় না হলেও হৃদয়ের আশেপাশেই ঘাসফুল রেখেছেন তাঁরা। তাই তো একুশে বিজেপিকে কার্যত ঘুম পাড়িয়ে সাগরদিঘির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আস্থা রেখেছিল তৃণমূলেই। সেবার মোট ভোট দাতা ছিল ১ লক্ষ ৮৬ হাজার ৮১৬ জন। তারমধ্যে ৯৫ হাজার ১৮৯ জন মানুষ বেছে নিয়েছিল তৃণমূলকে। দলের অন্দরে যতই বিবাদ থাক, শেষ হাসি হেসেছিলেন সুব্রতই।

সেই আসন নিজেদের দখলে নিতে এই অকাল ভোটে সেই সংখ্যালঘু সরণিতেই ঘুরেছেন এ বঙ্গের নেতারা। অন্তর্বর্তী তথ্য বলছে, সংখ্যালঘুরা ধারে কাছে আসবে না জেনেই বিজেপি এই ব্লকের ৮০ হাজার হিন্দু ভোটের ওপরে ভরসা খুঁজেছেন জিততে। মরিয়া হয়েছেন নির্বাচনের দিন যেন সেই ভোটের একটিও না ফসকে যায় অন্য কোনখানে। বিজেপি নেতারা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বলে দেশজুড়ে খ্যাতি আছে। তাঁরা যন্ত্রের আঁক কষায় ধরে নিয়েছিলেন মানুষ ভোট দেবেন কম। এদিন শেষ তথ্য অনুযায়ী ভোট পড়েছে ৭৫ শতাংশের একটু বেশি। তার মধ্যে এই ব্লকের সংখ্যালঘু হিন্দু কত জন তাঁদের পক্ষ নিলেন তা ফল দেখলেই বোঝা যাবে। ২০২১ সালের নির্বাচনে এখানে ভোট পড়েছিল ৭৮.৮৬ শতাংশ। উন্নয়নের থেকেও হিন্দুত্বের খ্যাতি বেশি বিজেপি’র। তাই প্রার্থী আনতে হয়েছে বহরমপুর থেকে। তাঁদের অঙ্ক ১৯৫১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হিন্দু মুখই এখানকার মানুষের আস্থা অর্জন করেছে।

কিন্তু কংগ্রেসের তো তা নয়। তাঁরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত। দেশের স্বাধীনতার পর সবথেকে বেশি সময় কেন্দ্রে শাসন করা এই দলটি সাগরদিঘিতে বাম আমলে ক্ষমতাই পায় নি। কিন্তু জোড়াফুল সরাতে অধীর চৌধুরী, বামেদের সঙ্গে বলা ভাল সিপিএম(আই)-এর সঙ্গে জোট করে তাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন এই আসনটি। তাতে ২০২১ সালে ৩৬ হাজার ৩৪৪ জনের অর্থাৎ ১৯.৪৫ শতাংশ মানুষের ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস। সেবার আইএসএফকে একমঞ্চে আমন্ত্রণ জানানোয় অধীর ও মহম্মদ সেলিমের মধ্যে চাপা ক্ষোভ টের পেয়েছিলেন রাজ্যবাসী‌‌‌। সেই ক্ষোভ কি কমেছে? দু’জনকেই একমঞ্চে এবার কিন্তু দেখে নি সাগরদিঘির মানুষজন। তাঁদের বিশ্বাস, দুই নেতার বৈরিতা এখনও কমে নি। আর সেই আবহেই এবার অধীর চৌধুরী ভেবেছিলেন জোড়াফুলের ‘দুর্নীতি’তে মানুষ মুখ ফিরিয়ে ‘হাত’ ধরবেন। তাই ধুলিয়ান থেকে ময়দানের বাইরের মানুষ বিড়ি মালিক সংখ্যালঘু মুখ বাইরন বিশ্বাসকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।একজন তরুণ। বিত্তশালী। সেই বিত্তের প্রদর্শনীতেও বিশ্বাস ফিরলো কি? তাঁর কথার গুরুত্ব কতটা দিলেন এলাকাবাসী তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র দু’দিন। যদিও তিনি জেতার ব্যাপারে আশাবাদী।

Bidi
সাগরদিঘির জীবন ও জীবিকা

তৃণমূল সরকারের ওপর সংখ্যালঘু মানুষজনের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে বলেই ইতিউতি তথ্য মিলছে। কিন্তু ‘দিদি’ তা সামলাতে সুরক্ষা কবচ দিয়ে সাজিয়েছেন দুর্গ। দলের চাহিদা থাকলেও সুব্রত’র বদলি ভরসা খুঁজেছেন হিন্দু মুখেই। অথচ মুসলিম অধ্যূষিত এজেলায় সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলিমরা পিছিয়েই আছেন এই তেইশেও। প্রকৃত উন্নয়নের বদলে তাঁদেরও সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে লক্ষ্মীর ভান্ডারে। পুরুষরা এখনও বাইরে কেন কাজে যেতে হবে সে প্রশ্ন তোলেন নি।ভাবী প্রজন্ম কেন স্থানীয়ভাবেই উৎপাদনক্ষম হতে পারবে না, সে প্রশ্ন তোলেন নি কেউ‌‌। বিড়ি শিল্পের বাইরে কেন অন্য শিল্প গড়ে উঠবে না সেই প্রশ্নও চাপা আছে মনে‌‌। কেন আরও একটি জেলা হাসপাতাল গড়ে উঠবে না মুর্শিদাবাদের এই উত্তর অংশে? সঙ্গত প্রশ্ন তোলার আগে, পেটের নিরাপত্তার আগে যে চাই প্রাণের নিরাপত্তা। তাই মাঝে মধ্যে মন বিদ্রোহ করে উঠলেও তাকে দাবিয়ে রাখতে হয়। তাই মেনে নিতে হয়। চাহিদা মত প্রার্থী না পেয়ে মুসলিমরা তলায় তলায় অন্য ভেলা খুঁজছেন, এই রিপোর্ট কি এবার পৌঁছেছিল নবান্নেও! ১৯ তারিখ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা শেষে ফের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুলতে থাকেন ‘ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে চাওয়া’ সংখ্যালঘু মুসলিমরা। তার মধ্যে তৃণমূল প্রচারের বাণী মেরামত করে প্রকাশ্যে আনে ‘প্রার্থী নয় দিদিই মুখ এই সাগরদিঘির।’ সেই বাণীতেই কি ভরসা রাখল সাগরদিঘি?
আগামীর অভিভাবক হিসেবে যাঁকেই বেছে নিক সাগরদিঘি, তাঁর কপালে লাগবে বসন্তের আবির। অকাল হোলিতে ভাসবে সে দিন। কিন্তু তারপর? সে উত্তর জোগাবে সময়।

তথ্য ঋণঃ উইকিপিডিয়া। (মতামত ব্যক্তিগত)