পরিযায়ীদের ঘরে ফেরা । তারপর ?

অনির্বেদ দে :বহরমপুর ১৭ই এপ্রিল- এই চলা থামতেই চাইছেনা। কখনো দুটো পা, কখনো সাইকেল। আর কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তা আমাদের সামনে তুলে দিচ্ছে না দেখা এক ভারতের ছবি।
যেন কোন ‘অলৌকিক’ কাহিনী। যে রাস্তা পেরিয়ে এসেছেন, যে সময় পেরিয়ে এসেছেন তা আসলে অলৌকিকই । কীভাবে যে এলেন, বুঝে উঠতে পারছেন না ডোমকলের আস্তাফ আলি ।
কথা হারিয়েছেন আস্তাফ।
প্রায় দুই মাস আগে গ্রামে তৈরি শাঁখা নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন আস্তাফ। ডোমকলের শাঁখা বিক্রি করতেন উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে। লক ডাউনে বন্ধ হয়ে যায় বিক্রিবাটা।
ফোনেই যোগাযোগ ছিল বাড়ির সাথে। স্ত্রী অসুস্থ, বাবারও বয়স হয়েছে। চিন্তা বাড়ছিল সবারই। কিন্তু ছোট মেয়ের কান্না শুনে আর বাড়িতে থাকতে পারেন নি আস্তাফ। বেড়িয়ে পরেছেন সাইকেল নিয়েই।
তারপর শুধুই চলা। থেমেছেন রাত্রে। কোথাও বাড়ির দাওয়া ঘুমোতে দিয়েছে কেউ, কোথাও স্কুল ঘরে খানিক বিশ্রাম নিয়েছেন।
আর গ্রামে ফিরেই প্রথমেই গিয়েছেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখান থেকে বাড়ি ঢুকে ঘরবন্দি করেছেন নিজেকে। কাউকে বিপদে ফেলতে চান না, তাই নিজের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছেন ১৪ দিন আলাদা থাকার।
একই রকম অভিজ্ঞতা । হরিহরপাড়ার সুন্দরপুরের বাসিন্দা আব্দুল লফিত, আলিনগরের লালন সেখ, সাহাজাদপুরের রমজান সেখ।
ওড়িষ্যা থেকে হরিহরপাড়া । এর দূরত্বই খাতায় কলেমে ছ’শো কিলোমিটার । অন্য হিসেবে চার দিন । টানা চারদিক ধরে চালিয়েছেন সাইকেলে রমজানরা। ।

লকডাউনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কাজ। রোজগার না থেকলে, সেখানে আর থাকা যায় না। দিন আনা দিন খাওয়ার বাঁচার যেন এটাই নিয়ম। এই নিয়ম মেনেই পশ্চিমবঙ্গের বাগরি অঞ্চলের উর্বর জমি ঘেরা গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে, কেউ ফেরি করতে ভিনরাজ্যে গিয়েছিলেন তারা। আর এক কামরার ভাড়ার ঘরও ছেড়ে আসতে হয়েছে, রুজি থেমে যাওয়ায়।
পকেটে কয়েকশ টাকা নিয়েই বন বাদার থেকে শহর, গ্রাম থেকে অচেনা ‘দেশ’ হয় নিজের মাটিতে ফেরা।
টিভির পর্দায় গ্রামের মানুষ দেখে নিয়েছেন, মুম্বাই শহরে তাদের ছেলেরা কীভাবে আছেন।
সেখানে, এ ফেরা কিছুটা স্বস্তি এনেছে বাড়িতে।
কিন্তু এই স্বস্তির আড়ালেই বেড়ে উঠছেন তীব্র হয়ে ওঠা অভাবের অন্য আখ্যান।
চিরকাল এভাবেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়েছেন শ্রমিকরা। যেখানে কাজ গিয়েছেন , কাজ করে হয়েছে ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েই।
সব থেকে ঝুঁকির কাজই করতে হয় বাঙালি শ্রমিকদের। থাকে না কোন নিরাপত্তা। কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হলে, মরদেহ টুকুই ফেরত পায় পরিবার।
সম্প্রতি কাশ্মীরে সাগরদিঘির পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। এরপরেও আমরা দেখেছি দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কিভাবে বিপদের মুখে পরেছেন মুর্শিদাবাদের শ্রমিকরা। প্রাণভয়ে বাড়িও ফিরেছিলেন অনেকে কিন্তু আবার ফিরে যেতে হয়েছে কাজ।
আসলে কাজের অভাবই জেলা থেকে ভিনরাজ্যে ঠেলে দিচ্ছে যুবকদের। স্কুলে বয়সেই মাঝেই শুরু হয়ে হয়ে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে কাজ শিখতে যাওয়ার রীতি। আর একটা সময় গ্রামের বেশিরভাগ যুবকই পাড়ি দিচ্ছেন কেরালা, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, মুম্বাই।
কেন গিয়েছিলেন ? এই প্রশ্ন আসলে শ্রমিকদের কাছে উত্তবৃত্তের দার্শনিক প্রহেলিকা মাত্র।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে কৃষিকে আমদের সরকার দায়িত্ব নিয়ে অলাভজনক একটি ব্যবস্থায় পরিণত করেছি।
কৃষক দরদের কথা শুধু টেলিভিশনের পর্দায় আর টোকেন অর্থ প্রদানের মাধ্যমেই হচ্ছে। এসবের মাঝেই বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে কৃষিকে।
অনেকের সাথে কথা বললেই দেখা যাবে, তারাও চাষ করছেন নেহাত অভ্যাসেই। আর নিজের শ্রম, পরিবারের শ্রম বিক্রি করার মতো সুযোগের অভাবে। শ্রমের বিনিময়ে অন্তত খাদ্য যেটুকু জোটে!
এই সময়টা পাট চাষের সময়। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জমিতে পাট বোনেন মুর্শিদাবাদের কৃষকরা। হরিহরপাড়ার পাটচাষি রকিবুল সেখের সাথে কথা বলতে জানা গেল, বিগত এক বছরেই পাট চাষের খরচ বেড়ে গিয়েছে প্রায় কুড়ি শতাংশ। সারের দোকানে বাকি পরে থাকা অর্থ মিটয়ে দেওয়া ইচ্ছে ছিল পয়লা বৈশাখে। সবজি চাষেও লোকসান হওয়ায় সারের দোকানে ‘বকেয়া ’ বেড়েছে আরো।
আসলে নব্বই দশকের পর থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে সারের দাম বাড়ছে। এখন ডিএপি সারের দাম প্রায় ২৭০০ টাকা কুইন্টাল। তার সাথে মেশাতে হয় পটাশ। পাঁচ বছরে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ডিএপি আর পটাশের। ফলে জমি থেকে সংসার চালানো প্রতিদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জানাচ্ছেন ডোমোকলের কৃষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা নাজিমুদ্দিন মণ্ডল।
এখন প্রশ্ন উঠেছেন। একদিকে কৃষিতে বেড়ে চলা সংকট, অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ চলে যাওয়া। এই দুইয়ের ধাক্কায় কি অবস্থা হবে গ্রামীন অর্থনীতির ?
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ, অতিমারীর আতঙ্ক আসলে আমাদের কাছে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আমাদের দেশকে চিনে নেওয়ার।
ক্রমশ সামনে আসছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে সরকারের উদাসীনতা। চাল আর গমের কথা শুনিয়ে মন ভোলানো যায় না।

পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক পি সাইনাথ সম্প্রতি প্রকাশিত একটি লেখায় প্রস্তাব রেখেছেন , মজুদ থাকা খাদ্য জরুরি ভিত্তিতে পরিযায়ী শ্রমিক এবং ‘অর্থনৈতিক সংকটে বিধ্বস্ত’ গরিব মানুষের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার। তিনি বলেছেন, “সরকারকে কৃষকের ফসল একবারে কিনে নিতে হবে”। সাফাই কর্মী, অস্থায়ী স্বাস্থ্য কর্মী, আশা, আইসিডিএস কর্মরীদের স্থায়ীকরণের পক্ষে সওয়াল করেছেন সাইনাথ । এই সময়ে তারা যে পরিষেবা দিচ্ছেন, আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
আমাদের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের মূল কথাগুলি নিয়ে সরব হওয়ার সময় এসেছে । এটাই সঠিক সময় শ্রমিক কৃষকদের সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে সচেতন হওয়ার।
আমরা এবার কি করব, সেটা নিজেদেরই ঠিক করতে হবে।