নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদ নগরীর ইদের কথা

ফারুক আব্দুল্লাহ: রমজান মাস হল সমগ্র মুসলিমদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস।এই মাসের অন্যতম উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করা।পুরো মাস ধরে কঠর রোজা বা উপবাস পালন এবং কৃচ্ছা সাধনের মাধ্যমে মুসলিমদের হৃদয় পবিত্র হয়।এই মাসেই তারা শিক্ষা নেয় কিভাবে সারা বছর ধরে সৎ কাজ করবে,সত্য পথে চলবে,কিভাবে দানধ্যান করবে,কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবে,অসহায় মানুষদের বিপদে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে,পাশে দাঁড়াবে।রমজানের আরও একটি বড় উদ্দেশ্য হল সম্পদশালী মানুষেরা দরিদ্র এবং অভুক্ত মানুষদের ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠায় তারা যেন অংশ নিতে পারে সেই শিক্ষা দেওয়া।

ইসলামে রমজানের উপবাস মানুষের উপর নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।শয্যাশায়ী,নিরাময় অযগ্য রোগী,গর্ভবতী মহিলা,সফরকারী মানুষকে রোজা পালন করা থেকে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতিকুল অবস্থা দূর হলে তখন তাদের সেই রোজা গুলি করে নিতে হবে।কোন ব্যাক্তি উপবাস করে ভুল বসত পেট ভরে খেয়ে নিলেও তার উপবাস ভঙ্গ হয়না।কিন্ত কেউ যদি ইচ্ছাকৃত একটি দানাও খেয়ে থাকে তবে তার উপবাস ভঙ্গ হয়ে যায়।রমজান মাস হল দানের মাস।এই মাসে দুস্থ অসহায় মানুষদেরকে প্রচুর দান করা হয়।রমজান মাসেই ইসলাম ধর্মের ৫টি স্তম্ভের অন্যতম একটি ‘যাকাত’ প্রদান করা হয়।

মহান আল্লাহ বলেছেন,‘তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা  কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ-ভাজন হতে পার।’’ (সূরা নূর-৫৬) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘হে মু’আয! তুমি জানিয়ে দাও আল্লাহ তাদের সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনী ব্যক্তিদের থেকে নিয়ে দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’’ (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি)।যাকাত সমস্ত সম্পদশালী মুসলিমদের জন্য অলংঘনীয়। যাকাত হিসেবে সম্পদশালী মুসলিম ব্যাক্তিদের এক বছরের সঞ্চিত মোট সম্পদ থেকে মাত্র আড়াই শতাংশ নেওয়া হয়।এই সমস্ত অর্থ অভাবী দরিদ্র অসহায় ব্যাক্তিদের মাঝে বন্ঠন করে দেওয়া হয় এছাড়াও রমজান মাসে ‘ফিতরা’ অর্থাৎ রোজা বা উপবাসে  কোন ভুলত্রুটি হয়ে গেলে তার ক্ষতিপুরণ হিসেবে ফিতরা বা কিছু নিদৃষ্ট অর্থ প্রদান করার নিয়ম।এই অর্থও বন্টন করা সহায় সম্বলহীন মানুষদের মধ্যে।যাকাত এবং ফিতরার উদ্দেশ্যে হল অর্থের অভাবে যেন ইদের উৎযাপন থেকে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে।রমজান মাসকে বলা হয় মানব জাতীর জন্য বরকতের মাস।এই মাসে কেউ যদি পবিত্র মনে ১ টাকা দান করে তবে সে ৭০ টাকা দান করার পূন্য অর্জন করবে এমন কথায় ইসলামে বলা হয়েছে। পুরো রমজান মাস শেষে আসে পবিত্র ইদের দিন।আরবি শব্দ ‘ইদ’ এর অর্থ ‘খুশি’।ইদ বিশ্বের সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব।ইদ বছরে দুটি। একটি ‘ইদ –উল-ফিতর’ বা দানের ইদ।এবং অপরটি ‘ইদ-উল-আযহা’ বা ত্যাগের ইদ। ‘ইদ-উল-ফিতর’ উৎযাপিত হয় প্রতি বছর আরবি  রমজান মাসের শেষে সাওয়াল মাসের প্রথম দিনে।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মত মুর্শিদাবাদ শহরেও ইদ পালিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ  ধরে।বাংলার অনান্য প্রান্তের ইদের থেকে মুর্শিদাবাদের ইদ কিছুটা হলেও বিভিন্নতার দাবি রাখে।কারণ মুঘল আমলে এই মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলা,বিহার,উড়িষ্যার রাজধানী।তাই নবাবদের পৃষ্টপোষকতায় এখানকার ইদ এক অন্য মাত্রা পেত।সমগ্র রমজান মাস জুড়েই রাজধানী নগরী খুশিতে মেতে উঠত।চারিদিক আলোয় সাজত।সন্ধ্যা বেলায় বিভিন্ন মসজিদে হত ইফতারীর আয়োজন।নাজাফি বংশীয় নবাবদের আমলে রমজান মাসে সন্ধ্যা থেকেই মুর্শিদাবাদের চক মসজিদ সেজে উঠত রঙিন আলোয় মসজিদে ইফতারিতে থাকত নানান রকমের শরবত,ফলের রস,কাবাব বিভিন্ন রকমের রুটি এবং নানান মিষ্টান্ন সহ বহু রকমের ফল।রমজানের বিশেষ দিন গুলিতে থাকত শাহী পোলাওয়ের আয়োজন।সেই সব দিনগুলিতে নবাবরাও সামিল হত ইফতারে।

ইদের দিন মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামত মেতে উঠত খুশিতে , নাজাফি বংশের শাসন আমলে নবাব সহ নিজামত পরিবারের সদস্যরা ইদের দিন সকাল বেলায় স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে গায়ে শাহী আতর লাগিয়ে জুলুস(মিছিল)সহযোগে বেরোতেন চক মসজিদে ইদের নামাজের উদ্দেশ্যে।নবাব বসতেন হাতীর পিঠে হাওদাতে।বাকিরা ঘোড়ায় চড়ে যেতেন, জুলুসের সামনে একদল বাদ্যকার নিজামত ব্যান্ড বাজাতে বাজতে এগিয়ে চলতো।জুলুসে নবাবের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরাও নবাবের সহযাত্রী হতেন, বহু সশস্ত্র সৈন্য নবাবের পাহারায় নিযুক্ত থাকত।যাত্রাপথে নবাব হাতীর পিঠে বসে রাস্তার দুই পাশের অগণিত প্রজাদের মাঝে টাকা ছিটিয়ে এগিয়ে যেতেন মসজিদের দিকে।

ইদের দিনে নিজামত পরিবারের বাবুর্চিখানায় রান্না হত নানান শাহী পদ। নবাব প্রাসাদে ইদ উপলক্ষ্যে বহু ইংরেজ আধিকারিদের নিমন্ত্রণ করা হত।তারা স্বপরিবারে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে উপস্থিত হতেন নবাবের প্রাসাদে এবং কবজি ডুবিয়ে  খেতেন।ইদের দিন রাজধানী মুর্শিদাবাদে দরিদ্র  জনসাধারনের জন্যও সরকারী উদ্দ্যোগে খোলা হত বেশ কিছু লঙ্গরখানা।সেখান থেকে পোলাও, রুটি , কাবাব  সহ  মাংসের আরও নানান পদ পরিবেশন করা হত।

আজ মুর্শিদাবাদের ঈদে  নবাবী আমলের সেই জৌলু্স নেই তবুও ইদ উপলক্ষ্যে আজও চক মসজিদ সেজে  ওঠে।সেখানে মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুর সহ নিজামত পরিবারের সমস্ত সদস্যরা নতুন পোশাকে  সজ্জিত হয়ে মজমুয়া, উদ,খস,গুলাব,হিনা,বেলি,চামনবাহার সহ আরও নানান আতর মেখে মসজিদে যায় ইদের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে।নিজামত পরিবারের মহিলা সদস্যরাও পৃথক ভাবে ইদের নামাজ পড়ে।ইদ উপলক্ষ্যে আজও নিজামত পরিবারে বিভিন্ন শাহী খাবার যেমন বিরিয়ানি কিম্বা পোলাও, পরতা,পুরি, মাংসের কাবাব,কিমা,রেজালা,বিভিন্ন রকমের সিমাই, জর্দা ইত্যাদি। এখনও ইদ উপলক্ষ্যে মুর্শিদাবাদ নিজামত পরিবারের সদস্যরা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী  আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করেন যা তাঁদের নিজেদের মধ্যের সম্পর্ককে আরও মজবুত ও প্রাণবন্ত করে তোলে।

কৃতজ্ঞতাস্বীকার:

১)সৈয়দ আব্বাস আলি মির্জা (মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুর)

২)সৈয়দ রেজা আলি মির্জা(নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্য)

৩)ডঃ সৈয়দ রেজা আলি খান(নবাব পরিবারের সদসস,শিক্ষক,গবেষক)

৪)ডঃ আব্দুল হাই(চিকিৎসক,ইসলামিক গবেষক)

৫)নাফিসা নিসা নাসির(নিজামত পরিবারের সদস্যা)

৬)সৈয়দ আতাহার আলি(নিজামত ইমামবাড়ায় কর্মরত)