শিক্ষার প্রসার, কর্মসংস্থানের অভাবেই পিছিয়ে মুর্শিদাবাদ, দাবি শিক্ষক মহলের

বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ চলতি বছর জেলায় ছেলেদের তুলনায় মাধ্যমিকে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। একইভাবে মাদ্রাসা পরীক্ষাতেও ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের থেকে বেশি। দিন কয়েক আগে জেলা সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছিলেন। স্কুল-কলেজ থেকে শপিং মল যেখানেই যাওয়া হোক না কেন মেয়েদের গুরুত্বই আলাদা। নেপথ্যে সরকারের সদিচ্ছা, অন্তত প্রচার এমনই। তবুও মুর্শিদাবাদ আছে মুর্শিদাবাদেই।

দুধের শিশুকে আছড়ে ফেলে মেরে ফেলেছে জওয়ান বাপ। পুলিশ তাকে ধরেছে। বাবার কু-কাজের প্রতিবাদ না করায় পুলিশ মা-কেও গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, পরপর তিনটে মেয়ে হওয়ার জন্যই সদ্যোজাত কন্যাকে মেরে ফেলেছে ডোমকলের রিন্টু সেখ। রিন্টু পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক। থাকে ভিন রাজ্যে। এই ঘটনার পর ফের জোরালো প্রশ্ন উঠছে মুর্শিদাবাদে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার নিয়ে। এই মানসিকতার জন্য আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি  শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার বলে মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, “ একজন পনেরো ষোলো বছরের ছেলের কাছে পড়াশোনার চেয়ে রোজগার গুরুত্বপূর্ণ তার গ্রাসাচ্ছদনের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই আড়ালে চলে যাচ্ছে শিক্ষা। আর শিক্ষার এই ঘাটতিই এই ধরনের ঘাতক তৈরি করছে সমাজে।”

মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রায় ৭৮ হাজার ৩৯১ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে এবছর। তার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। শিক্ষা ভবন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলা থেকে ৩০ হাজার ৫৮৯ জন ছেলে ও ৪৭ হাজার ৭৩০ জন মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় দিচ্ছে। হাইমাদ্রাসা পরীক্ষা দিচ্ছে ১৬ হাজার ২৪৭ জন। তারমধ্যে মেয়েদের সংখ্যা দশ হাজার ৮৪১ জন। ছেলেদের সংখ্যা ৫ হাজার ৪০৬ জন।

মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়া ইস্তক খবরে ভাসছে অনুপস্থিতির সংখ্যা। জঙ্গিপুর মুনিরিয়া হাই মাদ্রাসায় মোট নিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৪০ জন। তারমধ্যে ১৫০ জন ছাত্র ও ৩৯০ জন ছাত্রী। স্কুল সূত্রে জানা যায়, সোমবার হাই মাদ্রাসার ইংরেজী পরীক্ষা ছিল। সেই পরীক্ষায় ১০ জন ছেলে ও ৪২ জন মেয়ে পরীক্ষা দিতেই আসেনি। আবার খবর আসছে কোথাও পরীক্ষাচলাকালীন সন্তানের জন্ম দিচ্ছে নাবালিকা মা। কোথাও শোনা যাচ্ছে  পরীক্ষার ফর্ম ফিল ইন করেও কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে ছাত্র।

 

মাঝপথে শিক্ষা ছেড়ে দেওয়ায় অপূর্ণ শিক্ষা নিয়েই বাকি জীবন কাটাচ্ছে  আজকের ড্রপআউট পড়ুয়া। সেখান থেকেই সমাজে একটা ফারাক থেকে  যাচ্ছে বলে মনে করেন তোপিডাঙা হাইমাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক সৈয়দ মামুন অলবিরুণী। তিনি বলেন,”পরিবারে বাবা মা যদি নিজেদেরকে শিক্ষিত না করে, যদি নিজেরা না ভাবে ছেলে মেয়েদের জন্য কী ঠিক, কী ভুল তাহলে মুর্শিদাবাদের এই রকম ঘটনা আরও ঘটবে।”  রঞ্জন বলেন, “ জিনগত কারণ ছাড়াও একটি পরিবারের আদব কায়দা শিশু ছোট থেকে দেখে। শেখে। রপ্ত করে। সেখান থেকেও অপরাধ প্রবণতার জন্ম হয়। শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি বাল্য বিবাহ রোধ করা, ড্রপ আউট আটকাতেই হবে। তবেই যদি এই অবস্থার উন্নতি সম্ভব হয়। নয়তো এই অন্ধকার আরও গাঢ় হবে।”

পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা  শিক্ষা পর্ষদের সদস্য মহম্মদ আনসার আলী বলেন, “ আগের থেকে মুর্শিদাবাদে ছেলে  মেয়েদের শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। তবুও  প্রত্যন্ত গ্রামবাংলায় একেবারে নিচু স্তরে  শিক্ষার প্রসারকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। সেই চেষ্টা চলছে। আর সেই কারণে সম্পূর্ণ বাল্য বিবাহ, স্কুলছুট রোধ করা যায়নি।” তিনি আরও বলেন, “ সমাজে নতুন কর্ম সংস্থান না তৈরি হলে জেলায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা এক জায়গাতেই আটকে থাকবে। সেই জায়গা না থাকাতেই এইট পাশ করতে না করতেই ভিন রাজ্যের মজুরের দলে নাম লেখাচ্ছে নাবালক।”