স্বার্থের কাঁটা সরিয়ে খুশির ইদে আমরা হয়ে উঠি একে  অপরের আত্মীয় 

খাজিম আহমেদঃ খুব সহজ করে বলতে গেলে ইদ অর্থ খুশি। এই কথাটি আজকাল বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষমাত্র সকলেই জানেন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন “ও মন রমযানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ইদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আশমানী তাগিদ”। যা আজ বাঙালি মননে প্রবাদ বাক্যের মত মিশে গিয়েছে।

রমযান একটি আরবি মাসের নাম। রোজা (ফার্সি শব্দ) বা সিয়াম (আরবি শব্দ) অর্থ হচ্ছে অনুশোচনার দ্বারা নিজেকে দগ্ধ করা, পবিত্র করে তোলা। আর এই রোজার মাসে একজন বিশ্বাসীকে পালন করতে হয় চুড়ান্ত রকমের সংযম, ত্যাগ, দান এবং পুরো মানব সমাজের জন্য অপরিমেয় ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং সৌহার্দের বিষয়টিকে চর্চা করা বা যথার্থভাবে পালন করা।

আমার কিশোর কালে দেখিছি ধর্মীয় বিষয়গুলি গ্রামীণ ধর্মবেত্তা যাঁদের মৌলবি  বলে অভিহিত করা হয় তাঁরা এই রমযান মাসের সময়ে ইসলাম ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানদের মধ্যে এমনভাবে প্রচার করতেন যে রমযান মাসে যথার্থভাবে রোজা পালন না করলে সে প্রকৃতি মুসলমান হয়ে ওঠেন না। এই রোজার সময়ে বিশেষ সময়কালীন পর্যন্ত (সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত) খুঁত-পিপাসা নিয়ে অপেক্ষাকৃত অসুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষের যে ক্ষুধার যন্ত্রণা তা যদি কেউ অনুভব না করেন তাহলে মনুষ্যতের আর কী বাকি থাকে?  মৌলবিদের প্রচারের ফলে লক্ষ করা যেত আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই রোজা রাখতে উদগ্রীব থাকত। এর থেকে একটি বিশেষ বিষয় অনুধাবন করা যায় যে, কিশোর কিশোরীদের মধ্যে প্রকৃত ধর্ম জিজ্ঞাসা গড়ে না ওঠার আগেই তারা এই রোজার ব্রত পালন শুরু করত। হাল আমলে বিষয়টি সচেতনভাবেই ব্যপক অংশে পালিত হলেও জীবনের নানান জটিল কাজকর্মে নিয়োজিত থাকার ফলে সবসময় হয়তো এই ধর্মীয় নির্দেশ পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে গরীবদের মধ্যে দান ধ্যান এবং যাঁরা রোজা রাখেন অর্থাৎ রোজদার, তাঁদের জন্য যথাসাধ্য উৎকৃষ্ট  ‘ইফতার এর ব্যবস্থা করার। এরফলে  কিঞ্চিত মানসিক প্রশান্তি ঘটে।

রোজা ব্রত  পালনের মাধ্যমে ইসলাম বিশ্বাসীরা পুরো রমজান মাসে বিশেষভাবে শোভন জীবন যাপন, সমস্ত মানুষের জন্য শুভ কামনা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীর মধ্যে এবং ভিন্ন ধর্মালম্বী প্রতিবেশিদেরকেও আপন করে নেওয়ার জন্য নির্দেশ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে লক্ষ করা যাচ্ছে রোজার এই মহত্তম শিক্ষার বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করে বিশেষত রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য কেউ কেউ একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত এই রোজা বা  ইফতারের আয়োজন করে তাঁদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এর ফলে ইফতারের যথার্থ মাহাত্ম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

কিন্তু এতে হতাশার কোনও কারণ দেখি না। কেন না এই বঙ্গে কি হিন্দু ,কি মুসলমান রমজানের সময়ে তাঁদের একে অপরকে কাছে করে নেওয়ার অজস্র নজির রয়েছে। বাঙলার শ্বাশত আদর্শ হচ্ছে যুক্ত সাধনার প্রতীক অশেষ এক শ্রদ্ধাবোধ। আচার্য্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর থেকে অমর্ত্য সেন পর্যন্ত এই বিশ্বাসের কথা বারবার উচ্চারণ করছেন। আমরা তা সদ্যতন লক্ষও করছি। বাঙালি হিন্দু পরিবার থেকেও রোজাদার মুসলমানের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা হচ্ছে। এটাই বাস্তব। আবার মুসলিম পরিবারের তরুণরাও ওতপ্রোতভাবে দুর্গোৎসবে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে। কারণ ধর্ম যার যার উৎসব সবার।

উৎসবের মধ্যে উভয়বিদ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে আমরা সবাই সবার আত্মীয়  স্বজন ।  এমন সাম্প্রদায়িক  মানসিকতায় আচ্ছন্ন এই দুঃসময়ে এগুলিই আলোক বর্তিকা। এটাই আমার দেশের চিরন্তন বৈশিষ্ট, যেখানে সব মানুষ এক। ইদের তাৎপর্য হচ্ছে ধনী ও নির্ধনের মধ্যে ফারাক কমিয়ে নিয়ে আসা। আনন্দের কথা হল এই বিভেদ অনেকাংশে কমতে যাচ্ছে। বিভিন্ন মানুষের মধ্যে সমভাবাপন্ন মানসিকতা তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে। এটা আশার কথা। তবে বাণিজ্যিক গোষ্ঠী ইদ উল ফিতরের নামে যে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এসে সংবাদমাধ্যম যেভাবে মেতে উঠেছে তাতে কোনও শুভ চিন্তা নেই। আমরা আশা করবো বিভিন্ন মিডিয়ায় সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গ  তাঁদের দায়িত্বের পরিচয় দেবেন।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)